গুরুচাঁদ ঠাকুর স্মরণীয় কেন—শিক্ষা, সমতা ও সংগঠনের এক অনন্য নক্ষত্র
Bengal’s unsung Namasudra movement - Forward Press

গুরুচাঁদ ঠাকুর স্মরণীয় কেন—শিক্ষা, সমতা ও সংগঠনের এক অনন্য নক্ষত্র

গুরুচাঁদ ঠাকুর (গোপালগঞ্জের ওড়াকান্দি, ১৯শ শতকের মাঝামাঝি জন্ম)—মতুয়া দর্শনের সামাজিক প্রয়োগ, শিক্ষা-আন্দোলন, নারীশিক্ষা, জাতিভেদের বিরুদ্ধে সংগ্রাম এবং সংগঠন গড়ে তোলার মাধ্যমে উপেক্ষিত মানুষের জীবনে যে স্থায়ী পরিবর্তনের বীজ বপন করেছিলেন, সেই কারণে তিনি স্মরণীয় ও সমকালেও প্রাসঙ্গিক। তাঁর কাজের কেন্দ্রে ছিল—“সবার জন্য শিক্ষা”, “সমতার নৈতিকতা”, এবং “গৃহে থেকেই ধর্মীয়-নৈতিক কর্তব্য পালন”–এর মুক্তিদায়ী বার্তা। ইতিহাসের প্রেক্ষাপট, উদ্যোগ, নীতি-প্রভাব ও উত্তরাধিকার—সব মিলিয়ে গুরুচাঁদ ঠাকুর কেবল এক ধর্মীয়–সামাজিক নেতা নন; তিনি বাংলার উপেক্ষিত জনগোষ্ঠীর শিক্ষা-নেতাঅধিকার-রাজনীতির স্থপতি


জন্ম, প্রেক্ষাপট ও ধারাবাহিকতা

গুরুচাঁদ ঠাকুর ছিলেন মতুয়া মহাসংঘের প্রবর্তক হরিচাঁদ ঠাকুরের পুত্র। সূত্রভেদে তাঁর মৃত্যু-তারিখ ১৯৩৬ সালের ২৭ সেপ্টেম্বর বা ১৯৩৭—দুটি বছরই প্রচলিত; গবেষণা ও সাম্প্রতিক নিবন্ধে ১৮৪৬–১৯৩৭ সময়সীমাও ব্যবহৃত হয়েছে। যা-ই হোক, উনবিংশ–বিংশ শতকের সন্ধিক্ষণে তিনি পিতৃ-দর্শনের সামাজিক প্রয়োগকে এক নতুন উচ্চতায় পৌঁছে দেন। (Wikipedia)

“সবার জন্য শিক্ষা”—উদ্যোগের বিপ্লব

নিম্নবর্ণ/নমশূদ্র জনগোষ্ঠীর জন্য শিক্ষার দরজা তখন কার্যত বন্ধ। গুরুচাঁদ প্রথমে নিজের গ্রাম ওড়াকান্দিতে ১৮৮০ সালে পথশালা স্থাপন করেন; এটি ছিল উপেক্ষিত সমাজের জন্য বিদ্যালয় স্থাপনের এক পথিকৃত পদক্ষেপ। পরে তিনি গ্রামভিত্তিক কমিটি গড়ে বিদ্যালয়কে মন্দিরের চেয়েও অগ্রাধিকার দিতে উদ্বুদ্ধ করেন। ১৯০৭ সালে অস্ট্রেলীয় ব্যাপটিস্ট মিশনারি ডা. সি. এস. মিড–এর সহায়তায় ওড়াকান্দিতে Dr. C.S. Mead School নামে উচ্চ ইংরেজি মাধ্যম বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা হয়—যা তার শিক্ষা-আন্দোলনের প্রাতিষ্ঠানিক রূপকে আরো দৃঢ় করে। তাঁর জনপ্রিয় শ্লোগান—“ছেলে-মেয়ে দিতে শিক্ষা / প্রয়োজনে করো ভিক্ষা”—সমাজে শিক্ষাকে অধিকার হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করে। (Wikipedia)

নারীশিক্ষা, কন্যাবিবাহ ও সামাজিক সংস্কার

গুরুচাঁদ নারীশিক্ষাকে মুক্তির শর্ত হিসেবে দেখতেন—বাল্যবিবাহ ও পণপ্রথার বিরুদ্ধে অবস্থান নেন এবং নারীদের শিক্ষিত–আর্থিকভাবে সক্ষম করে তোলার ওপর জোর দেন। বিভিন্ন নিবন্ধে উল্লেখ আছে যে নারীশিক্ষা বিস্তারে তিনি আলাদা বিদ্যালয়/প্রশিক্ষণকেন্দ্রের উদ্যোগে ভূমিকা রাখেন; যার ফলে মতুয়া সমাজে সহ-অধিকারসহ-দায়িত্ব–এর চর্চা প্রসার লাভ করে। (IJCRT)

জাতিভেদবিরোধী নৈতিকতা: “ধর্মীয় মুক্তি সংসার-ধর্মে”

গুরুচাঁদ ঠাকুর জাতিভেদ ও অচ্ছুৎতার বিরোধী; তিনি উপদেশ দেন—ধর্মীয় মুক্তির পথ গৃহস্থ ধর্ম–দায়িত্ব, পরিশ্রম, সততা ও জনকল্যাণে। অর্থাৎ, নিরালসে সংসার–কর্তব্য পালনই আধ্যাত্মিকতার অংশ; কেবল আচার নয়, সেক্যুলার কর্তব্য (secular duties)–ও ধর্মীয় জীবনের অঙ্গ। এই বোধ সমাজকে আধুনিক শিক্ষা, কর্মনৈতিকতা ও সমতায় উদ্বুদ্ধ করে। (Banglapedia)

নামবদল, নীতি-স্বীকৃতি ও অধিকার-রাজনীতি

উপনিবেশিক বাংলায় “চণ্ডাল” নামটি অবমাননাকর ছিল। গুরুচাঁদের নেতৃত্বে ১৯০৭ সালে তিনি ও তাঁর অনুসারীরা প্রশাসনের কাছে স্মারকলিপি/দাবি জানিয়ে সামাজিক মর্যাদা, শিক্ষা ও চাকরিতে অধিকার নিশ্চিত করার উদ্যোগ নেন; ধারাবাহিক প্রচেষ্টার মধ্যে দিয়ে ১৯১১ সালের জনগণনায় ‘চণ্ডাল’ পরিবর্তে ‘নমশূদ্র’ নামটি চালু হয়, যা আত্মসম্মান ও ন্যায্য পরিচয়ের সংগ্রামে ঐতিহাসিক বাঁকবদল। এ প্রক্রিয়া পরবর্তী সময়ে বঞ্চিত শ্রেণির তালিকা/নীতিগত সুবিধা বিস্তারের পথও খুলে দেয়। (Wikipedia)

সংগঠন ও আন্দোলনের গতি

১৮৭২–৭৩ সালে নমশূদ্র স্বাভিমান আন্দোলন—সামাজিক–অর্থনৈতিক বয়কটের প্রেক্ষাপটে—গুরুচাঁদের নেতৃত্বে মতুয়া দর্শন সংগঠনভিত্তিক সামাজিক জাগরণে রূপ নেয়। তিনি জেলা–উপজেলা–গ্রাম পর্যায়ে কমিটি, সভা, পথশালা, স্বেচ্ছাসেবী নেটওয়ার্ক গড়ে তোলেন; তাঁর এই সাংগঠনিক দক্ষতা–ই পরবর্তীকালে মতুয়া মহাসংঘকে বিস্তৃত নেটওয়ার্কে পরিণত করে। (Banglapedia)

সংস্কৃতি ও কীর্তনধারা: ‘মতুয়া সঙ্গীত’

মতুয়া সমাজে কীর্তন/ভজনকে তিনি কেবল আচার নয়, সমবেত নৈতিক শিক্ষার মাধ্যম বানিয়েছেন। “মতুয়া সঙ্গীত”—হরিনাম, গুরুস্মরণ ও নৈতিকতার গান—মতুয়া সংস্কৃতির এক স্বতন্ত্র ঐতিহ্য, যেখানে হরিচাঁদ–গুরুচাঁদের বাণী ও মানবকল্যাণের আহ্বান প্রতিধ্বনিত। (Banglapedia)

প্রাতিষ্ঠানিক উত্তরাধিকার: বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত

গুরুচাঁদ–হরিচাঁদের নামে Harichand Guruchand University Act, 2018 পাশ হওয়া (পশ্চিমবঙ্গ) এই ঐতিহাসিক শিক্ষা–সংস্কার ধারা ও সামাজিক প্রভাবের এক রাষ্ট্রিক স্বীকৃতি। এটি স্মরণ করিয়ে দেয়—গুরুচাঁদের শিক্ষা-দর্শন আজও নীতিনির্ধারণের আলোচনায় প্রাসঙ্গিক। (wbhed.gov.in)


কেন গুরুচাঁদ ঠাকুর স্মরণীয়—দশটি নির্যাস

  1. শিক্ষাকে অধিকার হিসেবে প্রতিষ্ঠা: উপেক্ষিত সমাজের জন্য বিদ্যালয় স্থাপন (১৮৮০) ও উচ্চ বিদ্যালয় (১৯০৭)–সহ সুনির্দিষ্ট অবকাঠামো—“শিক্ষা না পেলে মুক্তি নেই”–এই বার্তার প্রাতিষ্ঠানিক রূপ। (Wikipedia)
  2. নারীশিক্ষা ও সামাজিক সংস্কার: বাল্যবিবাহ–পণপ্রথা–অশিক্ষার বিরুদ্ধে নৈতিক অবস্থান; নারীকে শিক্ষায় ও কর্মে সক্ষম করে তোলা। (IJCRT)
  3. জাতিভেদবিরোধী নৈতিকতা: ধর্ম–সাধনায় সেক্যুলার কর্তব্যের মর্যাদা—গৃহে থেকেই ধর্মীয়–নৈতিক জীবন; সমাজে মর্যাদা ও আত্মসম্মান। (Banglapedia)
  4. পরিচয়–রাজনীতির বাঁকবদল: “চণ্ডাল” থেকে “নমশূদ্র”—১৯১১ সালের স্বীকৃতি—আত্মপরিচয়ের উন্নতিতে এক ঐতিহাসিক মাইলফলক। (Wikipedia)
  5. গ্রাসরুটস সংগঠন গঠন: গ্রাম–কমিটি, পথশালা, সম্মেলন—অর্গানাইজেশনাল ইকোসিস্টেম সৃষ্টি; নেতৃত্ব–প্রশিক্ষণ ও স্বেচ্ছাসেবী নেটওয়ার্ক। (Banglapedia)
  6. সাংস্কৃতিক মবিলাইজেশন: ‘মতুয়া সঙ্গীত’কে নৈতিক–আধ্যাত্মিক শিক্ষার জনভাষা বানিয়ে সমাজে সমবেততা ও একাত্মতার আবহ। (Banglapedia)
  7. নীতি–প্রভাব ও অধিকার দাবি: প্রশাসনের কাছে স্মারকলিপি/ডেপুটেশন দিয়ে শিক্ষা, চাকরি ও প্রতিনিধিত্বে সুযোগ–বৃদ্ধির পথ খুলে দেওয়ার ধারাবাহিক চেষ্টা। (IJELS)
  8. সীমান্ত–অতিক্রমী ঐতিহ্য: বাংলাদেশ–পশ্চিমবঙ্গে মতুয়া সমাজের আধ্যাত্মিক–সামাজিক বন্ধনে তিনি কেন্দ্রবিন্দু; তীর্থ–সমাবেশে জীবন্ত স্মৃতি। (Wikipedia)
  9. নীতির ধারাবাহিকতা: PR ঠাকুরদের পরবর্তী প্রজন্মে সংগঠন পুনরুজ্জীবন; মতুয়া মহাসংঘের বিস্তার—গুরুচাঁদেরভাবে বপন করা বীজেরই ফল। (Wikipedia)
  10. রাষ্ট্রিক স্বীকৃতি: হরিচাঁদ–গুরুচাঁদের নামে বিশ্ববিদ্যালয়—শিক্ষা–উন্নয়নের দর্শনকে প্রতিষ্ঠানের স্তম্ভে রূপ দেওয়া। (wbhed.gov.in)

একটি বৃহত্তর গল্প: আধ্যাত্মিকতা থেকে সামাজিক ন্যায়

হরিচাঁদের দর্শন সমাজে ভক্তি–সমতা–মানবকল্যাণের বীজ বপন করেছিল; গুরুচাঁদ সেই বীজকে শিক্ষা–সংগঠন–নীতি–সংলাপ–এর মাটিতে রোপণ করে ফলিয়েছেন। তাঁর আধ্যাত্মিকতা নিভৃত সাধন নয়, বরং সমবেত কর্মধারা—কীর্তন, শিক্ষা, শৃঙ্খলা, সেবামূলক কাজ, ন্যায়ের দাবি—সব মিলিয়ে এক প্র্যাক্টিক্যাল ডিভোশন। এই দর্শন–আচরণই তাঁকে কেবল ধর্মীয় গুরু নয়, সোশ্যাল ইঞ্জিনিয়ার–এ রূপ দিয়েছে। (Banglapedia)

আজকের প্রাসঙ্গিকতা

২১শ শতকে শিক্ষা–বৈষম্য, লিঙ্গসমতা, ধর্মীয় সহনশীলতা ও সামাজিক ন্যায়ের প্রশ্নে গুরুচাঁদের কণ্ঠ আজও প্রাসঙ্গিক—“সবার জন্য শিক্ষা”, “জাতিভেদ নয়, মানবমর্যাদা”। স্থানীয় থেকে বৈশ্বিক—যেখানে যেখানে বঞ্চনা আছে, সেখানেই তাঁর শিক্ষা–নৈতিকতার সূত্র কার্যকর। নীতিনির্ধারকেরা তাঁর গল্পে দেখতে পারেন inclusive policy–র এক প্রাচীন ব্লুপ্রিন্ট; সমাজকর্মীরা খুঁজে পেতে পারেন গ্রাসরুটস সংগঠনের কার্যকর কৌশল; তরুণেরা শিখতে পারে—শিক্ষা ও সংগঠনই আত্মমুক্তির পথ।


উপসংহার

গুরুচাঁদ ঠাকুর স্মরণীয়—কারণ তিনি বিশ্বাস করতেন আত্মমুক্তি ও সামাজিক ন্যায় একে অপরের পরিপূরক। তিনি শিক্ষা দিয়ে মর্যাদা, সংগঠন দিয়ে শক্তি, এবং নৈতিকতা দিয়ে পথ দেখিয়েছেন। ওড়াকান্দির ছোট্ট গ্রাম থেকে শুরু হওয়া তাঁর সেই কাজ আজও বর্ণ–ধর্ম–সীমান্ত পেরিয়ে মানুষকে অনুপ্রাণিত করছে—শিক্ষিত হও, সংগঠিত হও, সমতার পথে এগিয়ে চলো। এ স্মৃতি কেবল অতীতচর্চা নয়; এটি অধিকার–মর্যাদার ভবিষ্যৎ রূপরেখা


উৎসনির্ভর উল্লেখ (মূল কয়েকটি ভিত্তি)

  • গুরুচাঁদের জীবনবছর, মতুয়া মহাসংঘের প্রেক্ষাপট ও ধারাবাহিকতা। (Wikipedia)
  • শিক্ষা-আন্দোলন: ১৮৮০-র পথশালা, ১৯০৭–এর Dr. C.S. Mead School, ডা. সি. এস. মিড–এর সহযোগিতা। (Wikipedia)
  • জাতিভেদ বিরোধী নৈতিকতা ও “secular duties”–এর উপর জোর; নিম্নবর্ণ আন্দোলনের সংগঠনগত ধারা। (Banglapedia)
  • ‘চণ্ডাল’ থেকে ‘নমশূদ্র’ (জনগণনা ১৯১১) নামপরিবর্তনের ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট। (Wikipedia)
  • মতুয়া সঙ্গীত: হরিচাঁদ–গুরুচাঁদভিত্তিক আধ্যাত্মিক সংগীত ঐতিহ্য। (Banglapedia)
  • Harichand Guruchand University Act, 2018—রাষ্ট্রিক স্বীকৃতি। (wbhed.gov.in)

তারিখ-নোট: গুরুচাঁদ ঠাকুরের মৃত্যুবছর ১৯৩৬/১৯৩৭—উভয় উল্লেখ মেলে; একাডেমিক/অফিশিয়াল নথিতে যে তারিখটি গ্রহণ করবেন, বিকল্প রেফারেন্সটিও নোটে উল্লেখ করা উত্তম। (Wikipedia)